চুল পড়া বন্ধের ঘরোয়া উপায় ২০২৩ । চলুন চুল পড়া বন্ধ করে কিভাবে জেনে নেয়া যাক

চুল মানব শরীরের একটি মৌলিক অংশ। এটি একটি কেরেটিন নামক প্রোটিন থেকে গঠিত হয়। চুল কালো হবার কারণে হলের উপর উপস্থিত একটি কালো রং হলো মেলানিন। মেলানিন চুলের কালো রং প্রদান করে এবং সূর্যের ক্রিয়ার পরিবর্তে বাড়তি মেলানিন উৎপাদন হতে পারে যা চুলের লম্বা বা বাংলা পরিবর্তন করে দেয়।

চুল তরল পদার্থ ছাড়া কিন্তু দুর্বল এবং ভাঙতে সহজ। চুল ভাঙতে বা ঝিঁঝিঁ হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে সবসময় সুন্দর রাখতে হয়। এছাড়া উষ্ণতা, সিলিকন, ফেনা এবং রাসায়নিক পদার্থগুলি চুলের অবস্থার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

স্বাভাবিকভাবে চুল প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ হেয়ার লক্ষ্য করা উচিত। সবচেয়ে সঠিক পুষ্টি এবং পরিচর্যার মাধ্যমে চুলকে সুন্দর রাখা সম্ভব।

চুল পড়া বন্ধের কিছু টিপস নিচে উল্লেখ করা হলো-

১.বাদাম
চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম, ওয়ালনাট, এগুলো তে আছে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, বিশেষ করে ওমেগা- ৬ ফ্যাট। যা চুলের গোড়া সতেজ রাখতে আর চুল লম্বা করতে সাহায্য করে। এই ওমেগা -৬ ফ্যাট আমাদের শরীর নিজে থেকে তৈরি করতে পারে না, খাবার থেকে নিতে হয়। এটার অভাবে মাথার চুল পরে যায়, চুলের রং হালকা হয়ে যায়। তাই প্রতিদিনের নাস্তায় কিছু বাদাম রাখতে পারেন। তবে অনেক খাবেন না, তাহলে ওজন বেড়ে যেতে পারে।

২.হলুদ আর কমলা রঙের সবজি এবং ফলমূল।
যেমন মিষ্টি আলু, গাজর, পেঁপে, আম, মিষ্টি কুমড়া এগুলো ভিটামিন ‘এ’ তে ভরপুর। চুলের ফলিকল অর্থাৎ চুলের গোড়া যেখান থেকে বড় হয় সেটা ঠিকমত কাজ করার জন্য দরকার ভিটামিন এ। আর সেটার খুব ভালো উৎস এই হলুদ এবং কমলা রঙের ফল এবং সবজি। দিনে যত পরিমাণ ভিটামিন এ দরকার আধা কাপ গাজরে এর অর্ধেকের বেশি হয়ে যায়। তাই দিনে কিছু হলুদ এবং কমলা রঙের ফল এবং সবজি খাওয়ার চেষ্টা করবেন।

৩.তৈলাক্ত মাছ।
প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে ওমেগা ৩ ফ্যাটের জন্য সামুদ্রিক মাছই খেতে হবে। যেমন টুনা, স্যামন। তবে আমাদের দেশি মাছ যেমন ইলিশ, কই, মলা, চাপিলা, এগুলো তেও ওমেগা ৩ ফ্যাট আছে। এগুলো চুল ঘন, কালো করতে সাহায্য করে। সাথে প্রোটিনের ভালো উৎস।

৪. ডিম।
সুন্দর চুলের জন্য ডিম আপনার খুব ভালো বন্ধু। কেনো বুঝিয়ে বলি। আমাদের চুল শর্করা বা ফ্যাটের তৈরি না। চুল প্রায় পুরোটাই প্রোটিনের তৈরি। আর আমরা গবেষণা থেকে নিশ্চিত জানি যে খাবারে প্রোটিনের অভাব হলে চুল পরে যায়। কিন্তু আামাদের অনেকের খাবারেই যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন থাকে না। কারণ আমরা ভাতটাই বেশি খাই। তাই সুন্দর চুলের জন্য খাবারে তালিকায় ডিম রাখবেন। সাথে ডিমে আরও অনেক কিছু বোনাস আছে। যেমন বায়োটিন, সেলেনিয়াম, ভিটামিন বি ১২ ইত্যাদি। এগুলো চুল ঘন,কালো আর সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।

৫.পালংশাক।
চুলের উপকারে পালংশাক একটি চমৎকার খাবার। এতে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে যা চুলের ভেতর থেকে পুষ্টি যোগায়। ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, আয়রন, ফলেট। এই সবগুলোই ঘন, কালো সুন্দর চুলের জন্য প্রয়োজন।

৬. ডাল।
সুন্দর চুলের জন্য ডাল খুব উপকারী। ডালে প্রোটিন আছে, ভালো পরিমাণে আয়রন আছে। আয়রন আমাদের মাথার তালুতে রক্ত সরবরাহ করে। চুলের গোড়ায় অক্সিজেন পৌঁছাতে সাহায্য করে। আমরা গবেষণা থেকে নিশ্চিত জানি যে আয়রনের অভাবে চুল পরে। সুন্দর চুলের জন্য ডালে আরো কিছু বোনাস আছে। যেমন জিঙ্ক, ফলেট। খুব পাতলা ডাল না খেয়ে ঘন করে রান্না ডাল খেলে এই পুষ্টি গুলো বেশি পাবেন।

৭. বিভিন্ন ধরনের বীজ।
যেমন চিয়া সিডস, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, সূর্যমূখীর বিচি, তিসির বীজ। এগুলোতে সুন্দর চুলের জন্য অনেকগুলো উপাদান আছে। যেমন চিয়া সিডস এ আছে প্রচুর পরিমাণে আলফা লিনোলিনিক এসিড। এক প্রকারের ওমেগা -৩ ফ্যাট। মিষ্টি কুমড়ার বিচিতে আছে জিঙ্ক, সূর্যমুখির বিচিতে আছে বায়োটিন, তিসির বীজে আছে সেলেনিয়াম। গবেষণায় চুল পরার সাথে এগুলোর অভাবের সম্পর্ক পাওয়া গেছে। সিডস কিভাবে খেতে পারেন? ভাত খাওয়ার সময় তরকারির ওপর একটু বীজ ছিটিয়ে দিতে পারেন। রাতে টক দই, অল্প দুধের সাথে চিয়া সিডস মাখিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। সকালে কিছু ফলের সাথে খেয়ে নিলেন।

৮.ছোলা।
ছোলায় চুলের জন্য ৩টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে। আয়রন, জিঙ্ক এবং প্রোটিন। এই ৩টার যেকোনোটার অভাবে চুল পরতে পারে। তাই চুল সুন্দর রাখতে মাঝে মাঝেই খাবারে ছোলা রাখতে পারেন।

৯. টক দই।
এটা প্রোটিনের আরেকটা উৎস। সাথে চুলের জন্য উপকারী আরও কিছু উপাদান আছে যেমন জিঙ্ক। প্রোটিনের জন্য মুরগির মাংস ও ভালো খাবার।

১০.টক ফল।
যেমন কমলা, মাল্টা, লেবু, কিউয়ি ফল। এগুলোতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি আছে। সুন্দর চুলের জন্য ভিটামিন সি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সি এর অভাবে চুল এমন বেকিয়ে যায় মেডিকেল এর ভাষায় corkscrew hair. আবার ভিটামিন সি এর অভাব হলে শরীর আয়রন শোষণ করতে পারে না।ফলে চুল পরে। শরীর নিজে থেকে ভিটামিন সি বানাতে পারে না। তবে টক জাতীয় ফল খেলে সহজেই সেখান থেকে নিয়ে নিতে পারে। যেমন ১টা কমলা থেকে দিনের প্রায় ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। যারা টক একটু কম খেতে পারেন তাদের জন্য টমেটো, পেয়ারা ভিটামিন সি এর ভালো উৎস হতে পারে। এই ১০ প্রকারের খাবার ভিতর থেকে চুলে পুষ্টি দিবে। এখন বলবো বাইরে থেকে পুষ্টি দেওয়ার জন্য কি ব্যবহার করতে পারেন। পাম্প কিন সিড ওয়েল বা কদুর তেল। চুল পরে যাচ্ছে এমন রোগীদের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে এই তেল টা ৩ মাস ব্যবহার করার পরে তাদের নতুন করে চুল গজিয়েছে। আর চুল আগের থেকে মোটা হয়েছে। তাই কদুর তেল ব্যবহার করে দেখতে পারেন। আমি কদুর তেল ব্যবহার করি। এই কোম্পানির সাথে আমার আর্থিক বা অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা যেকোনো ব্রান্ডের কদুর তেল ব্যবহার করতে পারেন। তাতে চুল পরা ঠেকাতে সাহায্য হতে পারে। এখন আসি চুল পরা ঠেকাতে কোন ভিটামিন কার্যকর।বাজারে অনেক ধরনের ভিটামিন ট্যাবলেট বিক্রি হয়। অনেক চমকপ্রদ কথাবার্তা থাকে সেখানে। তবে এর বেশিরভাগের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অযথা টাকা অপচয়। চুলের জন্য বেশিরভাগ পুষ্টি উপাদান আলাদা ট্যাবলেটের চেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে আসলেই ভালো। তবে একটি ব্যতিক্রম আছে। সেটা হলো ভিটামিন ডি। খাবার থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া খুব কঠিন। সহজ উপায় হলো রোদে সময় কাটানো। কিন্তু যাদের পক্ষে এটা সম্ভব না তারা আলাদা করে ভিটামিন ডি ট্যাবলেট খেতে পারেন। ভিটামিন ট্যাবলেটের ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হবে। কারণ অতিরিক্ত ট্যাবলেট নিলেও চুল পড়তে পারে। যেমন অতিরিক্ত ভিটামিন এ ট্যাবলেটের ফলে চুল পরে যায়। কিন্তু আপনি হলুদ রঙের সবজি খেয়ে শরীরে যতই ভিটামিন এ ঢোকান না কেনো তাতে ক্ষতি নেই।

এখন বলবো চুলের যত্নে কমন কিছু ভুল নিয়ে।
১.আপনি শ্যাম্পু ব্যবহারের পরে কন্ডিশনার ব্যবহার করেন না। এটা চুলের জন্য ক্ষতিকর। কারণ টা বুঝিয়ে বলি। আমাদের চুল ভালো থাকার জন্য কিছু তেল দরকার হয়। যা মাথার তালু থেকে এমনিতেই আসে। কিন্তু আমরা যখন শ্যাম্পু ব্যবহার করে চুল ধুই, তখন সেই তেল টাও ধুয়ে চলে যায়। কন্ডিশনারের কাজ হচ্ছে তেলগুলো আবার চুলে ফেরত দেয়া। তাই প্রতিবার চুলে শ্যাম্পু ব্যবহার করে কন্ডিশনার ব্যবহার করবেন।

২.ভেজা চুল ঘষে ঘষে মুছবেন না। আমরা অনেকেই গোসল করে তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে চুল মুছি। এতে চুল নষ্ট হয়। এমন না করে তোয়ালে দিয়ে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে দিয়ে পানি বের করবেন।

৩.ভেজা চুল আঁচড়াবেন না। এতে চুল নষ্ট হয়। চুল খুব কোকড়া না হলে একটু শুকিয়ে যাওয়ার পরে চওড়া দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াবেন।

৪.কার্লিং আয়রন দিয়ে চুল শুকাবেন না। চুল বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া সবচেয়ে ভালো। তবে যদি কার্লিং আয়রন ব্যবহার করতেই হয়, সবচেয়ে কম হিটে ব্যবহার করবেন, যত অল্প সময় ধরে করা যায়। সপ্তাহে একবারের বেশি ব্যবহার না করার চেষ্টা করবেন।

৫. খুব টাইট করে চুল বাঁধবেন না। যারা খুব টাইট করে চুল বেধে রাখেন, সেই টানের কারনে চুল পড়তে পারে।

শেষে বলছি চুল পরার চিকিৎসা। কিছু রোগের কারণে চুল পরতে পারে। যেমন থাইরয়েডের রোগ, রক্তশূণ্যতা। আপনার যদি খাবার দাবার ঠিক থাকে, চুলের যত্ন নেন ঠিক মতো তাও চুল পরতে পারে। তাহলে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। তিনি খতিয়ে দেখবেন কোনো রোগের কারণে এমন হচ্ছে কিনা। রোগ ধরা পরলে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করা যাবে। চুল পরতে থাকার অন্যতম একটা কারন হলো Androgenetic Alopecia নামের রোগ। এই রোগে ছেলেদের মাথায় টাক পরা শুরু করে। কপালের দুই পাশ থেকে চুল টাক হতে পারে। মেয়েদের সাধারণত টাক হয় না, চুল পাতলা হয়ে যায়। মাথার সিঁথি বড় হয়ে যায়। এই দুই ক্ষেত্রেই চিকিৎসা আছে। দুইটা ওষুুধ খুব ভালো কাজ করে। ওষুধ গুলোর নাম হলো মিনক্সিডিল আর ফিনাস্টেরাইড। চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। তিনি দেখতে পারবেন আপনার এই রোগ টা হয়েছে কিনা এবং কোন ওষুধ ভালো হতে পারে। ওষুধ ছাড়া আরও কিছু উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে দেশে যেমন মাথার পিছন থেকে চুল এনে সামনে বসানো। তারপর পিআরপি থেরাপিতেও কেউ কেউ উপকার পাচ্ছেন। অর্থাৎ চুল পরার অনেক ধরনের চিকিৎসা আছে। একজন ডারমাটোলোজিস্ট বা স্কিনের ডাক্তারের কাছে গেলে তারা চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন। এভাবে আপনি খুব সহজে ঘরোয়া পদ্ধতিতে চুল পড়া বন্ধ করতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *