এসএসসি/দাখিল/ভোকেশনাল পরীক্ষার ফর্ম পূরণে নির্ধারিত ফি: অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে দিশেহারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবক
আসন্ন ২০২৫ সালের এসএসসি, দাখিল এবং এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষার ফর্ম পূরণের জন্য বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ফি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে, বোর্ড নির্ধারিত এই ফির বাইরেও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, যা বিশেষ করে দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের জীবনে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
📝 বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ফি (২০২৫ সালের নোটিশ অনুযায়ী)
শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত নোটিশ অনুযায়ী, বিভিন্ন বিভাগ ও ধারার পরীক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত ফি কাঠামো নিম্নরূপ:
| পরীক্ষার ধরন | বিভাগ/ধারা | কেন্দ্র ও ব্যবহারিক ফিসহ মোট নির্ধারিত ফি (টাকা) |
| এসএসসি (স্কুল) | বিজ্ঞান বিভাগ | ২২২০/- |
| ব্যবসা শিক্ষা | ২১২০/- | |
| মানবিক | ২১২০/- | |
| মাদ্রাসা (দাখিল) | বিজ্ঞান বিভাগ | ২৪৩৫/- |
| সাধারণ, মুজাব্বিদ ও হিফজুল বিভাগ | ২১৬০/- | |
| এসএসসি (ভোকেশনাল) | নিয়মিত | ২১৬৫/- |
| অনিয়মিত | ১৪০০.০০ + |
গুরুত্বপূর্ণ নোট: বোর্ড স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, “বোর্ড নির্ধারিত ফি এর অতিরিক্ত আদায় করলে প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।” তবে, ফর্ম পূরণের অনলাইন সংক্রান্ত কাজের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত ১০০/- থেকে ১৫০/- টাকা প্রয়োজন হতে পারে, যা যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত।
😭 অতিরিক্ত ফি’র চাপে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
নোটিশের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান নির্ধারিত ফির চেয়ে কয়েকশ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি দাবি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে ৫০০ টাকার মতো সামান্য অর্থের অভাবেও অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা ফর্ম পূরণ করতে পারছে না, যা তাদের শিক্ষাজীবনকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন যে, কতিপয় প্রধান শিক্ষক অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে এতটাই অনমনীয় যে, এক পয়সাও কম নিতে তারা রাজি নন।
🚨 করণীয়: অতিরিক্ত অর্থ দাবি করলে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন
বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন মহল মনে করেন, অর্থের অভাবে কোনো শিক্ষার্থীর জীবন যেন ঝরে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। বোর্ড নির্ধারিত সরকারি ফি মেটানোর পরও যদি কোনো প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা উচিত।
এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে:
-
ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) বা ডিসি (জেলা প্রশাসক) মহোদয়কে অবহিত করুন। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ (যেমন: রশিদ, লিখিত নোটিশ) সহ অভিযোগ জানালে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
-
শিক্ষাবোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করুন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই পদক্ষেপগুলো অতিরিক্ত ফি আদায়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করবে। কোনো অবস্থায়ই যেন শিক্ষার্থীদের জীবনের বিনিময়ে বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

স্কুল তাহলে ফরম ফিলাপ বাবদ এত বেশি টাকা নেয় কেন?
স্কুলগুলো ফর্ম ফিলাপ বাবদ বোর্ড নির্ধারিত ফি-এর চেয়ে বেশি টাকা নেওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ (বা অজুহাত) থাকে। এই কারণগুলো মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: যুক্তিসঙ্গত কারণ (যা সামান্য বাড়তি খরচের জন্য প্রযোজ্য) এবং অযৌক্তিক বা অবৈধ কারণ (যা অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মূল উৎস)।
এখানে প্রধান কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:
১. অবৈধ বা অযৌক্তিক কারণ (যা অতিরিক্ত ফি-এর মূল উৎস)
এই কারণগুলোই সাধারণত শিক্ষার্থীদের ওপর সবচেয়ে বেশি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে এবং যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল বৃদ্ধি: অনেক স্কুল ফর্ম ফিলাপকে একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উন্নয়নমূলক কাজ (যেমন: নতুন ভবন তৈরি, ল্যাব সরঞ্জাম কেনা, মাঠ সংস্কার ইত্যাদি) বা অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে।
-
শিক্ষকদের ব্যক্তিগত সুবিধা (ঘুষ): কিছু ক্ষেত্রে, ফর্ম ফিলাপের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত শিক্ষক বা কর্মচারীরা অতিরিক্ত টাকা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন।
-
বকেয়া আদায়: অনেক স্কুল এই সময়কে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি, মাসিক বেতন, বা অন্যান্য বকেয়া ফি (যা আগে পরিশোধ করা হয়নি) একবারে আদায় করে নেয়। বকেয়া পরিশোধ না করলে ফর্ম পূরণ করতে দেওয়া হয় না।
-
অন্যান্য খাতের ফি জোর করে যুক্ত করা: অনেক সময় তারা উন্নয়ন ফি, বিদায় অনুষ্ঠান ফি (Farewell), কোচিং ফি, মডেল টেস্টের ফি, বা বিশেষ ক্লাসের ফি বাধ্যতামূলকভাবে ফর্ম ফিলাপ ফির সাথে যুক্ত করে দেয়, যদিও বোর্ড এই ফিগুলো নিতে নিষেধ করে।
২. আংশিক যুক্তিসঙ্গত কারণ (ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য বাড়তি খরচ)
এই কারণগুলো বোর্ড নির্ধারিত ফি-এর অতিরিক্ত হলেও ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য পরিমাণ (যেমন: আপনার নোটিশে উল্লেখিত ১০০-১৫০ টাকা) যুক্তিসঙ্গত হতে পারে।
-
অনলাইন প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যাংক চার্জ: ফর্ম পূরণের কাজটি সাধারণত অনলাইনে করতে হয়। এই কাজের জন্য ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ খরচ, অপারেটরের মজুরি এবং ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার সময় যে সার্ভিস চার্জ বা ব্যাংক কমিশন লাগে, তার জন্য কিছু বাড়তি টাকা নেওয়া হয়।
-
ফটোকপি ও আনুষঙ্গিক অফিসিয়াল কাজ: ফর্ম ফিলাপ সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরি, একাধিক ফটোকপি, ডকুমেন্ট সংরক্ষণ ও বোর্ড অফিসে পাঠানোর জন্য অতিরিক্ত প্রশাসনিক খরচ হয়।
-
আসা-যাওয়ার খরচ (যাতায়াত): স্কুলের প্রতিনিধিকে অনেক সময় একাধিকবার ব্যাংকে বা বোর্ডের আঞ্চলিক অফিসে যেতে হয়, যার জন্য যাতায়াত খরচ লাগে।
⚖️ গুরুত্বপূর্ণ দিক
বোর্ড নির্ধারিত ফি-এর অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা অবৈধ। বিশেষ করে, যখন এই অতিরিক্ত ফি কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত হয় এবং ৫০০ টাকার অভাবে কোনো শিক্ষার্থীর ফর্ম পূরণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন এটি পুরোপুরি অনৈতিক এবং বেআইনি। এই ধরনের অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) বা ডিসি (জেলা প্রশাসক)-এর কাছে অভিযোগ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।


