দেশের পর্যটনকে নিরাপদ ও টেকসই করতে নতুন আচরণবিধি ২০২৫ । বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণয়ন করা হয়েছে?
বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে আরও নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই করার লক্ষ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্প্রতি “নিরাপদ ও টেকসই পর্যটন আচরণবিধি, ২০২৫” প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আচরণবিধি পর্যটন শিল্পে নিয়োজিত সকল অংশীজন, যেমন— পর্যটক, পর্যটন সেবাদাতা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই আচরণবিধিটি দেশের পর্যটনসেবার মান, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দায়িত্বশীল পর্যটন-কে উৎসাহিত করবে। বিশেষত, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে পর্যটকদের ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এই বিধিতে।
আচরণবিধির গুরুত্ব:
পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আচরণবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার পর্যটন খাতকে একটি নীতিমালার কাঠামোর মধ্যে আনতে চাইল। এর মূল লক্ষ্যগুলো হলো:
- পর্যটকদের সুরক্ষা: পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং প্রতারণা বা হয়রানি থেকে রক্ষা করা।
- পরিবেশ সংরক্ষণ: পর্যটকদের দ্বারা পরিবেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও বিধি-নিষেধ আরোপ করা। যেমন: সেন্টমার্টিন দ্বীপের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় পরিবেশ রক্ষার্থে ইতোমধ্যে দৈনিক পর্যটক সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
- স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি সম্মান: পর্যটকরা যেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, সেই বিষয়ে উৎসাহিত করা।
- সেবার মান: হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ট্রাভেল এজেন্সি-সহ সকল সেবাদাতার জন্য একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড নিশ্চিত করা।
সম্প্রতি বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন পর্যটনকে কেবল অর্থনৈতিক টুল হিসেবে না দেখে এটিকে নিরাপত্তা, পারিবারিক আনন্দ ও অন্তর্ভুক্তির প্রতীক হিসেবে দেখার ওপর জোর দেন। তিনি সে সময় জানান, পর্যটকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যটন স্পটগুলোতে আচরণবিধি চালু করা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় আশা করছে, নতুন এই আচরণবিধি পর্যটন খাতে সুশাসন নিশ্চিতকরণ, গতিশীলতা আনয়ন ও সেবার আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটি নিরাপদ ও দায়িত্বশীল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে সহায়ক হবে।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য এবং বৈশ্বিক টেকসই পর্যটন নীতির আলোকে, এই আচরণবিধিতে মূলত চারটি প্রধান ক্ষেত্রের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা পর্যটক এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
“নিরাপদ ও টেকসই পর্যটন আচরণবিধি, ২০২৫”-এর মূল লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু:
১. নিরাপদ ভ্রমণ ও যাত্রী সুরক্ষা (Safety and Security)
- পর্যটকদের নিরাপত্তা: পর্যটন স্পটগুলিতে পর্যটকদের, বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং তাদের জিনিসপত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
- প্রতারণা রোধ: ট্রাভেল এজেন্সি এবং সেবাদাতাদের দ্বারা পর্যটকদের সাথে যেকোনো ধরনের প্রতারণা বা হয়রানিমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকা। সম্প্রতি এয়ার টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার কারণে ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা এই বিধির নৈতিক কাঠামোরই অংশ।
- স্বাস্থ্য ও জরুরি ব্যবস্থা: আপদকালীন বা দুর্ঘটনায় দ্রুত সহায়তা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সেবাদাতাদের প্রস্তুত থাকা।
২. পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ (Environmental and Biodiversity Conservation)
- পরিবেশবান্ধব আচরণ: পর্যটকদের প্লাস্টিক বর্জন, আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা এবং পরিবেশ দূষণকারী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা।
- সম্পদ সংরক্ষণ: জল ও বিদ্যুতের মতো দুষ্প্রাপ্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া।
- সংবেদনশীল এলাকা সংরক্ষণ: সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় পরিবেশের ধারণক্ষমতা (Carrying Capacity) মেনে পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
- দায়িত্বশীল সমুদ্র পর্যটন: সমুদ্র সৈকত এলাকায় পর্যটকদের অসচেতন ও বেপরোয়া আচরণ রোধ করে নিরাপদ সমুদ্র পর্যটন নিশ্চিতকরণের জন্য জরুরি সতর্কবার্তা মেনে চলা।
৩. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা (Socio-Cultural Respect)
- স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি সম্মান: পর্যটকরা যেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, ধর্মীয় রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং পোশাকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
- স্থানীয় অংশগ্রহণ: পর্যটন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা এবং পর্যটন থেকে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক সুবিধা যেন স্থানীয়দের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করা।
- মানব ও শিশু অধিকার: পর্যটন শিল্পে শিশুশ্রম ও যৌন হয়রানি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা এবং নারী, শিশু, বয়স্ক ও ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা করা।
৪. সুশাসন ও স্বচ্ছতা (Governance and Transparency)
- স্বচ্ছ লেনদেন: সকল সেবাদাতাকে (যেমন: হোটেল, রেস্তোরাঁ) খাদ্য বিক্রির ক্ষেত্রে রশিদ প্রদান বাধ্যতামূলক করা এবং মূল্য তালিকা প্রদর্শন করা।
- পর্যটন নীতিমালা ও আইন মান্য: পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ট্রাভেল এজেন্সি আইন, পর্যটন নীতিমালা এবং অন্যান্য সরকারি নির্দেশিকা কঠোরভাবে অনুসরণ করা।
- নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি: সকল পর্যটন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (হোটেল, মোটেল, ট্রাভেল এজেন্সি) নিবন্ধন নিশ্চিত করা এবং তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
মোটকথা, এই আচরণবিধি পর্যটনকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।



