শবে বরাতের নামাজের নিয়ত ও নিয়ম । শবে বরাতের নামাজ না পড়লে কি হয়?

রাসুল্লাহ (সা:) বলেছে সাবান মাসে ১৪তম দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই এ রাতে নফল ইবাদত করে আল্লাহ’র নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা হয়-এ সম্পর্কে কোরআনে কোন উল্লেখ নেই – শবে বরাতের নামাজের নিয়ত ও নিয়ম

শবে বরাত কি?–শবে বরাত একটি ইসলামিক উৎসব যা মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এটি আরবি ভাষায় “শব” শব্দের আওতায় তৈরি হয়েছে, যা মানে কাঁদার অর্থ রাখে। এই উৎসবটি শবে বরাত নামে পরিচিত।শবে বরাত ইসলামিক ক্যালেন্ডারের শাবান মাসের ১৪ তারিখে উপস্থিত। এটি মুসলিম সমাজের একটি পুরাতন উৎসব এবং এটি সম্পূর্ণরূপে কোরআন বা হাদীসে উল্লেখ করা নেই। তবে, এটি মুসলিম সমাজের একটি ব্যপক উৎসব হিসাবে প্রচলিত।

শবে বরাতের দিনে মুসলিম সমাজের বেশি অংশ রাতে ইবাদত করে বিশেষ দোয়া পড়ে। এই দোয়াগুলির মধ্যে বেশ কিছু পড়ে হয় যা মুসলিম সমাজের প্রতিটি স্ত্রী-পুরুষ সদস্য দোয়া পড়তে পারে। এছাড়াও দান, দরিদ্র ও অনাহার মানুষদের জন্য খাদ্য বিতরণ করা হয়।

পবিত্র কোরআনে কি শবে বরাতের কথা উল্লেখ আছে? ‘শবে বরাত’ সম্পর্কিত আমল গুলো এবং এর প্রমাণিকতাকে একেবারেই অস্বীকার করা, এগুলোকে ভিত্তিহীন মনে করা,যেমনটা লা মাযহাবীরা করে থাকেন,তা কোনো ভাবেই ঠিক নয়। এছাড়া কেউ কেউ সূরা দুখানের নিম্নোক্ত আয়াতকে এ রাতের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। যেমন উল্লেখিত হয়েছে— إنا أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةٍ مُّبَٰرَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ، فيها يفرق كل أمر حكيم

অর্থঃ “নিশ্চয়ই আমি উহা (কুরআন শরীফ) এক বরকতময় রজনীতে নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী,ওই রাত্রিতে সমস্ত হিকমতপূর্ণ কাজ সমূহের বন্টন করা হয় তথা বন্টনের ফায়সালা করা হয় |”(সূরা আদ-দুখান/৩-৪) । মনে রাখা জরুরি,’শবে বরাতের’ প্রমাণ্যতা শুধু হাদীস শরীফ দ্বারা,পবিত্র কুরআনে উক্ত রজনীর কোন উল্লেখ নেই।

এ আয়াতে উল্লেখিত ‘লাইলাতুন মুবারাকা’ তথা ‘বরকতময় রাত’ দ্বারা যারা ‘শবে বরাত’ উদ্দেশ্য নিয়েছেন, এটি ভুল। উক্ত আয়াত দ্বারা ‘শবে বরাত’ উদ্দেশ্য নয়; বরং ‘শবে ক্বদর’ উদ্দেশ্য। কারণ, কুরআনে কারীম লাওহে মাহফুয হতে দুনিয়ার আসমানে ‘শবে ক্বদরেই’ নাযিল হয়েছে। ‘শবে বরাতে’ নাযিল হয়নি। (ইলমী খুতুবাত:২/২৪৭,তুহফাতুল আলমায়ী ৩/১১৪) । আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উক্ত বরকতময় রজনীতে সঠিকভাবে শরীয়া মোতাবেক ইবাদাত -বান্দেগী করার তাওফীক্ব দান করুন।

নফল ইবাদত একাকী ঘরে বসে করাই উত্তম / মসজিদে জমা হয়েই ইবাদত করতে হবে এমনটি নয়

মুস্তাহাব কি? মুস্তাহাব হলো ইসলামিক আমলের একটি ধরণ যা ফরয বা আস্থায়ী বা আমুলক নয়। ইসলামে একটি আমল যদি ফরয হয় তবে সেটি সম্পূর্ণ বাধ্যতামূলক হয় এবং আমলটি করা হলে একটি বিশেষ ফয়েজ (সাবলের হিসাব মতে আজর এবং সওয়াব) পাওয়া যায়। অন্যদিকে, মুস্তাহাব আমলের জন্য কোন বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু এগুলি করা হলে একটি আমুলক ফয়েজ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, নামায পড়া ফরয হলেও তার আগে ও পরে কিছু সুন্নত নামায পড়াটি মুস্তাহাব। এছাড়াও মুস্তাহাব আমলের উদাহরণ হতে পারে এমন কাজসমূহ যেমন সূরা ইখলাস পড়া, তাহাজ্জুদ নামায পড়া, সাম্য ও মুসাফিরাত করা ইত্যাদি।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ত ও নিয়ম । শবে বরাতের নামাজ না পড়লে কি হয়?

কেন শবে বরাতের রাত গুরুত্বপূর্ণ? হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন: হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন: এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত; এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে এবং দিনে নফল রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ; সুতরাং নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নফল নামাজ। প্রতিটি নফল ইবাদতের জন্য তাজা অজু বা নতুন অজু করা মুস্তাহাব। বিশেষ ইবাদতের জন্য গোসল করাও মুস্তাহাব। ইবাদতের জন্য দিন অপেক্ষা রাত শ্রেয়তর।

১৫ ই শাবান সম্পর্কে সবকটি হাদীস সামনে রাখলে ‘লাইলাতুল বরাতে’ মোট চারটি বিষয় সঠিক এবং আমল যোগ্য হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

  1. ১৫ই শা’বানের রজনীতে আল্লাহ তা’আলার তাওফীক্ব দান অনুযায়ী ঘরে বসে একাকী ইবাদত-বান্দেগী করা।
    কিন্তু,আমরা এই রজনীটিকে হৈ-হোল্লোড়ের রাত বানিয়ে ফেলেছি। মাসাজিদ ও করবস্থান গুলোতে একত্রিত হয়ে ভীড় করি,রকমারি খাবারের আয়োজন করে থাকি, হাক-ডাক করি,এসব অবাঞ্ছনীয় এবং বর্জনীয়। যারা এসব কাজ করে,তারা ক্ষতিগ্রস্থ।এসবের যেভাবে কোনো প্রমাণ্যতা নেই,তদরূপ বাস্তবতার সাথেও এসবের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই। বরকতময় এ রজনীতে বেশি বেশি করে নফল নামাজ আদায়,যিকর-আযকার ও কুরআনে হাকীমের তেলাওয়াত করা চাই। তবে পূর্ণ রাত জাগ্রত থেকে নাফল এবাদাত করা এটি জরুরি নয়। আল্লাহ তা’আলা যতটুকু করার তাওফীক্ব নসীব করেন,দল বেঁধে মসজিদে সমবেত না হয়ে একাকিভাবে ঘরে (কিংবা মসজিদে) আদায় করা। কেননা,এটি ব্যক্তিগত আমল,যৌথ কিংবা সমবেত হয়ে আদায়ের কোনো আমল এটি নয়।
  2. পরের দিন রোযা রাখা। এটি একটি মুস্তাহাব আমল।
  3. পবিত্র এ রজনীতে নিজের জন্যে,আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদের জন্যে,এবং সমস্ত উম্মতে মুসলিমার জন্যে মাগফিরাতের দোয়া করা। আর এ জন্য করবস্থানে যাওয়া অবশ্যক নয়। তবে একাকী ও বিক্ষিপ্তভাবে কবরস্থানে গিয়ে জিয়ারত করা যাবে। এ রজনীতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘জান্নাতুল বাক্বীতে’ গিয়েছেন,কবরবাসীদের জন্যে দোয়া করেছেন,এটি সত্য। তবে প্রকাশ্যে নয়; বরং তিনি গোপনে গিয়েছিলেন। আর ঘটনাক্রমে বিষয়টি আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহা জেনে যান। কিন্তু,রাসূলুল্লাহ এ রাতে করবস্থানে যাওয়ার জন্যে কোনো প্রকার হুকুম প্রদান করেননি। সুতরাং আমাদের সমাজে যেই তামাশা হয়,কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে সমবেতভাবে দোয়ার যে হিড়িক জমে,তা সম্পূর্ণরূপে ভূল এবং রুসম-রেওয়াজ।
  4. যে দুই মুসলমানের মাঝে লড়াই-ঝগড়া ও বিভেদ বিদ্যমান,তারা এ রজনীতে পরস্পরকে ক্ষমা করে সন্ধি করে নিবে। যতক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরকে ক্ষমা করে সন্ধিবদ্ধ না হবে,ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ক্ষমা পাবে না। একটি যায়িফ-দুর্বল হাদীসে নবীজী(সা,) এরশাদ করেছেন–এ রজনীতে(ছয় প্রকার ব্যক্তি) মুশরিক, হিংসুক,আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী,টাখনুর নিচে জামা (লুঙ্গী,পা জামা,কুর্তা ইত্যাদি) ঝুলিয়ে পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান এবং মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি ছাড়া সকল মুসলমানকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন। উল্লেখিতদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা রহমতের দৃষ্টিতে দেখবেননা। (বায়হাক্বী শোআবুল ঈমান৩/৩৮৪) ১৫ই শাবানের রাতে এই চারটি আমলই যায়িফ তথা দুর্বল হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। শরীয়তের মূলনীতি অনুযায়ী কোন বিষয়ে সহীহ হাদীস বিদ‍্যমান থাকা পর্যন্ত যায়িফ-দুর্বল হাদীসের উপর আমাল করা যাবে না। কেননা,সহীহ হাদীসের বিপরীতে যায়িফ হাদিসের উপর আমল গ্রহনযোগ্য নয়।
    তবে, যদি কোনো বিষয়ে শুধুমাত্র যায়িফ-দুর্বল হাদীসই থাকে,সহীহ কোনো হাদিস না থাকে,তখন যায়িফ হাদীসের উপরই আমল করা যাবে। এটাই সমস্ত মুহাদ্দিসীন,ফুক্বাহা ও মুফাসসিরীনের অভিমত।
    আর এমন বিধান শুধু একটিই নয়,বরং ‘শবে বরাত’ ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে,যেগুলোর ক্ষেত্রে শুধু যায়িফ হাদীসই পাওয়া যায়। সুতরাং যায়িফ হাদীসের মাধ্যমেই সেগুলোর ক্ষেত্রে আমল গ্রহনযোগ্য। যেমন— ‘সালাতুত তাসবীহ্’ সম্পর্কিত এগারোটি বর্ণনা রয়েছে,সবকটি রেওয়ায়াত যায়িফ। এতদসত্ত্বেও সালাফে সালেহীন থেকে ‘সালাতুত্ তাসবীহ্’র আমল প্রমাণিত ও প্রচলিত।

শবে বরাতের আমল কি সুন্নত?

না। যায়িফ হাদীস দ্বারা ওয়াজিব,সুন্নাতে মুয়াক্কাদা-এর সমপর্যায়ের আমল প্রমাণিত হবে না। সুতরাং যে হুকুম ‘সালাতুত্ তাসবীহ’র ক্ষেত্রে যে, এটি পড়া মুস্তাহাব। ঠিক ১৫ই শাবানের রাতের ক্ষেত্রেও একই হুকুম প্রযোজ্য। অর্থাৎ এ রজনীতে একাকী ইবাদাত-বান্দেগী করা মুস্তাহাব। কেননা,এ সংক্রান্ত যে সমস্ত বর্ণনা পাওয়া যায়,সব গুলো যায়িফ-দুর্বল। তাই এগুলোর দ্বারা মুস্তাহাব আমলই প্রমাণিত হতে পারে। সুতরাং ‘শবে বরাত’ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীস সমূহ দ্বারা উপরোল্লেখিত চারটি আমলই মুস্তাহাব বলে গণ্য করা হবে।

সূত্র:মোঃ শাহাদাত হোসেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *