পাকিস্তানি লোকসংগীতের সুর যেমন
পুরোনো বই বেচাকেনার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আচমকাই বইটার হদিস মেলে। পরে বিক্রেতার সঙ্গে দরদাম করে দ্রুতই নিজের করে নিই। ৫৬ বছরের পুরোনো বইটা হাতে পাওয়ামাত্রই একটা তৃপ্তির ঝাপটা শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তরতর করে একের পর এক পাতা ওলটাতে থাকি। একলহমায় ১৯৬ পৃষ্ঠার বইয়ের আদ্যোপান্তে চোখ বোলানো হয়ে যায়।
বইটা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৬ সালের মে মাসে, তখনো পাকিস্তান অখণ্ড। বইয়ের নাম পাকিস্তানের লোক গীতি। প্রকাশক ছিল পাকিস্তান পাবলিকেশনস। ঠিকানা ১৯৮, কাকরাইল, ঢাকা-২। মূল্য ২ টাকা। মুদ্রাকরের পরিচিতিতে উল্লেখ আছে, ‘ম্যানেজার, গভর্নমেন্ট অব পাকিস্তান প্রেস, তেজগাঁও, ঢাকা-৮’।
পাকিস্তানের লোক গীতি বইটি সম্পাদনা কিংবা সংকলন কে বা কারা করেছেন, এমন কোনো তথ্য বইয়ে মুদ্রিত নেই। তবে লোকসাহিত্যচর্চার ইতিহাসে এ বইটি এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নায়ক। বিশেষত অখণ্ড পাকিস্তানের লোকায়ত ধারার গানের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য এ বই নির্ভরযোগ্য এবং সমৃদ্ধ এক দলিল।
বইয়ের সূচি দুটি পর্বে বিন্যস্ত। মূলত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের লোকগীতি নিয়ে সাতজন লেখকের রচনা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামের একটি পর্বে সংকলিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ নামের আরেকটি পর্বে সংকলিত হয়েছে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লোকগীতি নিয়ে রচিত আটটি লেখা।
‘পূর্ব পাকিস্তান’ পর্বে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের ‘বাউল, মুর্শিদী ও মারেফতি’ ও মুখাখ্খারুল ইসলামের ‘পালাগান ও গীতিনাট্য’ সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া একই পর্বে ঠাঁই পেয়েছে আতোয়ার রহমানের ‘মেয়েলী গান’, আবদুল্লাহ সাঈদের ‘বারমাসী গীতি’, লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর ‘বিচার, তরজা ও কবিগান’, মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুমের ‘জারি ও সারি গান’ এবং খালেদ হাসানের ‘ভাটিয়ালী ও ভাওয়াইয়া’।
‘পশ্চিম পাকিস্তান’ পর্বভুক্ত আটটি লেখা মূলত অনূদিত হয়ে মুদ্রিত হয়েছে। এতে ‘পাঞ্জাবী লোক-গীতি’ শিরোনামে লিখেছেন আবদুস্ সালাম খুরশীদ। দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম ‘পটোয়ার উপত্যকার বিয়ের গান’, লেখক মাজেদ সিদ্দিকী। এ ছাড়া মোহাম্মদ মুসা খান কলীম লিখেছেন ‘পশ্তু লোক-গীতি’। ‘পাঠান লোক-গীতি’ নামের রচনাটির লেখকের নাম বইয়ে উল্লেখ নেই। এ ছাড়া সলিম খান গিম্মীর ‘বালোচ লোক-গীতি’ ও এস আমজাদ আলীর ‘সিন্ধী লোক-গীতি’ নামের দুটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। বইয়ে ইউনুস মাস্তুরের ‘গুজরাটি লোক-গীতি’ এবং সলিম খান গিম্মীর ‘আজাদ কাশ্মীরের লোক-গীতি’ শীর্ষক দুটি লেখাও আছে।
বইয়ে পাঁচটি দুর্লভ আলোকচিত্র ও চারটি রেখাচিত্র আছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জারিগানের আসর এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকগীতি পরিবেশনার দুটি আলোকচিত্রের পাশাপাশি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধির এক লোকগায়ক, গান পরিবেশনারত পাঞ্জাবের পল্লিবালিকা ও পাঞ্জাবি নারীদের নৃত্যগীত পরিবেশনার আলোকচিত্র মুদ্রিত হয়েছে। চারটি রেখাচিত্রের দুটি পূর্ব পাকিস্তানের। একটি মুর্শিদি গায়কের, অন্যটি সারিগানের দৃশ্য। অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মসংগীত পরিবেশনার দৃশ্য দুটি পৃথক রেখাচিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন তাঁর রচনায় বাউল, মুর্শিদি ও মারফতি গানকে লোকসংগীতের একটি গাছের তিনটি ফল বলে চিহ্নিত করেছেন। মুখাখ্খারুল ইসলাম পালাগানকে বাংলার আধুনিক ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কাহিনিকাব্যের পূর্বপুরুষ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আতোয়ার রহমান জানিয়েছেন, উপলক্ষের প্রয়োজনে প্রতিটি অঞ্চলে বহু মেয়েলি গানের জন্ম হয়েছে।
আবদুল্লাহ সাঈদ বারোমাসি গানকে ‘বিরহ-গীতি’ এবং লুৎফুল হায়দার চৌধুরী তরজা গানকে কবিগান ও বিচারগানের পূর্বরূপ বলে দাবি করেছেন। মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম জারি ও সারিগানের ইতিহাস এবং পরম্পরার বর্ণনা দিয়েছেন। খালেদ হাসান লিখেছেন ‘ভাটিয়ালী ও ভাওয়াইয়া’ শিরোনামে প্রবন্ধ।
লোকগানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানও যে প্রাচুর্যময় একটা অঞ্চল, তা পাকিস্তানের লোক গীতি বইয়ের ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ পর্বের পরতে পরতে উদ্ভাসিত হয়েছে। এ পর্বে সংকলিত আটটি লেখায় পাকিস্তান ভূখণ্ডের লোকগানের নানা ধারা-উপধারার সুর-স্বর স্পষ্ট হয়েছে।
আবদুস্ সালাম খুরশীদ মাহিয়াগীতি, ঢোলকগীতি, ঘোড়ীগীতি, সোহাগগীতি, চরকার গান আর ঘুমপাড়ানি ছড়াগান নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। মাজেদ সিদ্দিকী তাঁর লেখায় পটোয়ারের লোকসংস্কৃতি পাকিস্তানের অমূল্য সম্পদ বলে মন্তব্য করেছেন। মোহাম্মদ মুসা খান কলীম পশ্তুর প্রাচীন গীতিকার আমির কেরর পেহ্লভান ও আবু মোহাম্মদ হাশিম সম্পর্কে লেখার পাশপাশি পশতু লোকসংগীতের ধারা-উপধারা, আঙ্গিকবৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
‘পাঠান লোক-গীতি’ প্রবন্ধে সেখানকার লোকগানের গীতিকৌশল, পরিবেশনারীতি আর কাব্যমানের বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সলিম খান গিম্মী বালোচ জাতির সংস্কৃতি ও গান নিয়ে আলোচনা করেছেন। এস আমজাদ আলী ভিট্ আলোকপাত করেন শাহ্ আবদুল লতিফের সংগীত ও জীবন নিয়ে।
ইউনুস মাস্তুর মেয়েদের ধান কোটার গান, ঘুমপাড়ানিয়া গান, ভাবসংগীত, ভজন, শক্তির আরাধনাগীত, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগীত এবং নাবিক সংগীত নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সলিম খান গিম্মী পশুচারকদের গীত, বসন্তের গীত, শোকপূর্ণ লোকগীতি, আনন্দ-উল্লাসের গান, বিয়ের গান ও যুদ্ধকাব্য নিয়ে লিখেছেন।
বলে নেওয়া ভালো, এমন ঈর্ষণীয় সংকলন খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের লোক গীতি প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি যেমন লোকসাহিত্যচর্চায় অগ্রগণ্য সংকলনের মান্যতা পেয়েছে, তেমনই এমন ধরনের মূল্যবান সংকলন আগে-পরে খুব একটা বেরোয়নি।
হাতে গোনা কিছু ছাড়া প্রায় প্রতিটি সংকলনেরই কোনো না কোনো অপূর্ণাঙ্গতা আছে। তবে এ সংকলনের ক্ষেত্রে এমনটা বলা একটু কঠিনই। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের লোকগানের প্রচলিত ধারা-উপধারা নিয়ে কখনো সংক্ষেপে, কখনো সবিস্তার আলোচনা করেছেন লেখকেরা। পাকিস্তানের লোকায়তগানের ধারা কতটুকু সমৃদ্ধ ছিল, এর হদিস আর ঠিকুজি লুকিয়ে আছে মূলত পাকিস্তানের লোক গীতি বইয়ে। এটি এমনই এক বই, যা লোকসাহিত্যচর্চার এক দাপুটে সংযোজন, রত্নকোষও বটে।